খুলনা | বৃহস্পতিবার | ২৯ মে ২০২৫ | ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

প্রেম, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক অনুপম নিদর্শন গাজী কালু চম্পাবতীর মাজার

মোঃ হাবিব ওসমান, কালীগঞ্জ |
১১:২৫ পি.এম | ০১ জুলাই ২০২৩


ইতিহাসের সেই গাজী-কালু-চম্পাবতীর গল্প আমরা অনেকেই শুনেছি, তাদের সেই স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে তখনকার আমলের কিছু ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা বৈরাট নগরে গাজী কালু ও চম্পাবতির সমাধিস্থলে মাজার স্থাপন করেন। এই মাজারে প্রতিদিন ভক্তরা মনোবাসনা পূরণে মাজারের বটবৃক্ষের ঝুড়িতে বেঁধে রেখে যান রং-বেরং চিকন পলিথিন। আগতরা বলেন গাজী কালু চম্পাবতির এই মাজারে কোন কিছু মানত করে ঝুড়িতে কিছু বেঁধে রেখে গেলে মনোবাসনা পূরণ হয়। এই বিশ্বাস থেকেই প্রতিদিন দূর-দুরান্ত থেকে মাজারে আগমন ঘটে শত শত নারী- পুরুষের।
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজারের পূর্বপাশে সামান্য একটু দূরে গাজী কালু-চম্পাবতীর মাজার অবস্থিত। গাজী কালু চম্পাবতীর মাজারের গা ঘেঁষে রয়েছে ৬টি ছোটবড় বটবৃক্ষ। প্রত্যেকটির গোড়া শান দিয়ে ঘেরা। গাছ থেকে ঝুলে আছে ঝুড়ি, আর সেই ঝুড়িতে, ডালে এবং পাশের আরও দু’টি ভিন্ন বৃক্ষে শোভা পাচ্ছে নীল, সাদা, লাল, খয়েরি বা কালো নানা রঙের চিকন চিকন পলিথিন-সুতোর মতো করে গাঁথা। মনোকামনা পূরণে এক ধরণের বিশ্বাসী মানুষ এগুলো বেঁধে রাখেন। তবে দেশ-বিদেশের অন্যসব মাজার বা স্মৃতিস্তম্ভে দেখা যায় মানতকারীরা সুতো বাঁধে আর এখানে পলিথিন দিয়ে সুতোর মতো করে বাঁধা হয়েছে। পলিথিন সুতোর চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী বলেই এই ব্যবস্থা কি না-কে জানে। 
মাজারের আসা মানতকারীরা বললেন, মানুষজন নানা মানত করে এগুলো বেঁধে রাখে। তাদের ধারণা এই মাজারের বদৌলতে তাদের কামনা বাসনা পূরণ হবে। তবে মনের আশা পূরণের এই পলিথিন তাদের জীবনে কোনও পরিবর্তন এনেছে কি না জানা যায়নি। 
গাজী-কালু ও চম্পাবতীর পরিচয় নিয়ে আছে নানা কিংবদন্তী। জনশ্র“তি আছে তৎকালীন বিরাটনগরের শাসক দরবেশ শাহ্ সিকান্দারের ছেলে গাজী, আর কালু হচ্ছেন সিকান্দারের পোষ্য ছেলে। কালু তার পালক পিতার সন্তান গাজীকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং সর্বত্র তার সঙ্গী হতেন। একদিন গাজীর সঙ্গে ছাপাইনগরের সামন্ত রাজা রামচন্দ্র ওরফে মুকুট রাজার কন্যা চম্পাবতীর দেখা হয়। চম্পাকে দেখে গাজী আর চম্পাবতীও গাজীকে দেখে ভুলে গিয়েছিলেন। স্থান-কাল-পাত্র ও বাস্তবতায় চম্পাবতী ভুলে যান তিনি হিন্দু রাজার মেয়ে আর গাজীও ভুলে যান তিনি মুসলমান শাসকের পুত্র। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্বাভাবিক নিয়মে তাদের মিলনের মাঝে দুর্ভেদ্য প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায় সামাজিক ও ধর্মীয় বাঁধা। মুকুট রাজা তার সেনাপতিদের হুকুম দেন গাজী ও কালুকে শায়েস্তা করতে। যুদ্ধে মুকুট রায়ের সেনাপতি দক্ষিণা রায় পরাজিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে গাজীর অনুসারী হন। গাজী-কালু ও চম্পাবতীর মাজারের সাথে দক্ষিণা রায়ের মাজারও আছে। 
গাজী কালু ও চম্পাবতীর মাজারে হিন্দু, মুসলিম নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ মানত করে। শ্রীরাম রাজার বেড় দীঘির দক্ষিণ পাশে ৩টি পাশাপাশি কবরের অবস্থান। মাঝখানে বড় কবরটি গাজীর, পশ্চিমেরটি কালুর এবং পূর্বের ছোট কবরটি চম্পবতীর বলে পরিচিত। মাজার সন্নিহিত দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি প্রাচীন বটগাছ আছে। এই বটগাছের তলদেশে একটি শূণ্যস্থান দেখা যায়। এটিকে অনেকে প্রাচীন কূপ কিংবা অন্য কোনও কবর বলে মনে করেন। 
১৯৯২ সালে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসন কবর তিনটি বাঁধাই করে বেষ্টনি প্রাচীর নির্মাণ ও খাদেমদের থাকার জন্য সেমিপাকা টিনশেড তৈরি করে দেয়। তবে বাংলাদেশের শহর-গ্রামে ব্যাপকভাবে প্রচলিত গাজী-কালু-চম্পাবতীর গল্প-কাহিনীর সত্যাসত্য নিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে বিশেষজ্ঞ-ইতিহাসবিদদের অনেক মতভেদ আছে।
মাজারের সামনে স্থাপিত একটি শিলালিপিতে উলে­খ আছে গাজী-কালু-চম্পাবতীর বিষয়ে যেসব বিবরণ পাওয়া যায় তা সবই ঐতিহাসিক উপাখ্যান এবং গাজীর গীত, উপন্যাস, পুঁথি সাহিত্য, কিংবদন্তী, জনশ্র“তি বা স্থানীয় প্রবাদ সর্বস্ব। সুতরাং গাজীর ঐতিহাসিক সত্যতা সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করা দুরূহ ব্যাপার। তবে সিলেট থেকে সুন্দরবন হয়ে গাজী নামে যে আধ্যাত্মিক সাধক বারোবাজার বা ছাপাইনগরে এসে হাজির হন তিনি বহু বৌদ্ধ ও হিন্দুকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা দেন। যশোর জেলায় তার আগমনকাল নিশ্চিত করে বলা না গেলেও এতটুকু বলা যায় যে গাজী, কালু, চম্পাবতী কিংবদন্তী কিংবা বাস্তবতায় তারা বারোবাজার থেকেই সর্বপ্রথম ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করেছিলেন গোটা দক্ষিণ বাংলায়।