খুলনা | বুধবার | ২৩ অক্টোবর ২০২৪ | ৭ কার্তিক ১৪৩১

সন্তানের জন্য মাতা-পিতার করণীয়

ড. মুহাম্মদ বেলায়েত হুসাইন |
০১:১৭ এ.এম | ০৪ অগাস্ট ২০২৩


মাতা-পিতার জন্য সন্তান-সন্ততি মহান রব্বুল আ’লামিনের পক্ষ থেকে এক আকর্ষণীয় নিয়ামত। ইহলৌকিক জীবনে মানুষের প্রিয়তম বস্তু ও হৃদয়ের অন্যতম আনন্দ ও আখিরাতের জীবনের সাথী ও আনন্দ। সন্তানদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে সত্যিকারের আনন্দের উৎস বানাতে আমাদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। এ বিষয়ে ইসলামে যে নির্দেশনা রয়েছে তা সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হলো।
১. আদর্শ মাতা-পিতা নির্বাচন করা : একটি শিশু জন্মের আগে থেকেই তার প্রতি মাতা-পিতার দায়িত্ব শুরু হয়ে যায়। এজন্য প্রথম দায়িত্ব হলো সন্তানের জন্য যোগ্য পিতা ও মাতা বাছাই করা। শুধুমাত্র পাত্র বা পাত্রীর ব্যক্তিগত আনন্দ, তৃপ্তি ও জাগতিক সুবিধাদির দিকে দৃষ্টি না দিয়ে আগত প্রজন্মের কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে বিবাহের পাত্র-পাত্রী নির্ধারণ করা। উভয় পক্ষকে সততা, ধার্মিকতা ও নৈতিক দৃঢ়তার দিকে লক্ষ্য রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
২. স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণের অধিকার দেওয়া : একটি শিশু যখন মায়ের গর্ভে ভ্র“ণ অবস্থায় বিরাজ করে তখন এটা তার অধিকার হয়ে পড়ে যে মাতৃগর্ভে তার যথোচিত সংরক্ষণ এবং স্বাধীনভাবে তাকে এই পৃথিবীতে আসার সুযোগ করে দিতে হবে, তাকে হত্যা করা হবে না বরং গর্ভে থাকাকালীন সময়ে তাকে যথোচিত নিবিড় পরিচর্যা করতে হবে। এটি সৃষ্টিকর্তা নির্ধারিত অধিকার।
৩. কানে আযান ও ইকামত দেয়া : সন্তান দুনিয়াতে আসার পর গোসল দিয়ে পরিস্কার করে তার ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামত দেয়া।
৪. তাহনীক করা : নবজাতক শিশুকে জন্মের কয়েকদিনের মধ্যে কোনো নেককার বুজুর্গের নিকট নিয়ে তাঁর মুখের মধ্যে খেজুর, মধু বা অনুরূপ কোনো খাদ্যদ্রব্য ছোয়ানকে ‘তাহনীক’ বলা হয়।
৫. মাথা মুড়ানো ও সাদকাহ করা : শিশুর জন্মের সপ্তম দিনে তার মাথা মুড়ানো এবং চুলের সমপরিমাণ রৌপ্য ফকির-মিসকিনদের মধ্য বিতরণ করে দেওয়া।
৬. সুন্দর নাম রাখা : সন্তানের সুন্দর নাম রাখা পিতা-মাতার উপর একটি কর্তব্য। লক্ষণীয় হলো নামের সৌন্দর্য ও অর্থ। শরীয়ত বিরোধী অশ্লীল ও কুরুচি সম্পন্ন নাম না রাখা। 
৭. আকীকা করা : ইসলামী সংস্কৃতির অন্যতম বিষয় হলো সন্তানের আকীকা করা।
৮. খাতনা করা: ছেলেদের খাতনা করানো এটি একটি অন্যতম সুন্নাত।
৯. দুই বছর সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো: মা’এর উপর দায়িত্ব দুই বছর সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো।
১০. আদর স্নেহ ও ভালবাসা দেয়া: সন্তানদেরকে স্নেহ করা এবং আন্তরিকভাবে ভালবাসা, সময় দেওয়া, আনন্দ দেওয়া। আত্মিক ও মানসিক দিক থেকে শক্তিশালী রূপে গড়ে তোলা।
১১. প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করা: ছেলে সন্তানদেরকে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত এবং মেয়ে সন্তানদেরকে বিবাহ পর্যন্ত লালন-পালন করা।
১২. সক্ষম করে তোলা: সন্তানদেরকে এমনভাবে সক্ষম করে গড়ে তোলা, যেন তারা উপার্জন করার মত যোগ্যতা অর্জন করতে পারে।
১৩. বিবাহ দেয়া: সুন্নাহ পদ্ধতিতে বিবাহ দেয়া এবং বিবাহর যাবতীয় কাজ সম্পাদন করা এবং উপযুক্ত সময়ে বিবাহর ব্যবস্থা করা।
১৪. প্রতারণা বা মিথ্যা আচরণ না করা : শিশুরা সাধারণত তাই বলে যা সে শোনে এবং তাই করে যা সে দেখে। এজন্য তাদের সামনে মিথ্যা কথা বলা বা মিথ্যা আচরণ থেকে বিরত থাকা। সর্বদা কথার মিল থাকা।
১৫. সন্তানদের মাঝে ইনসাফ করা : একাধিক সন্তানের মাঝে ইনসাফ তথা সমতা বিধান করা।
১৬. ঈমান শিক্ষা দেয়া : শিশুকালে শিশুদের অন্তর পরিস্কার থাকে। এ সময়ে তাদের অন্তরে আল্লাহর মহানত্বের শিক্ষা স্থাপন করে দেয়া এবং তাদেরকে এ কথা বলা যে, কোন প্রয়োজন, সমস্যা ও দুঃখ-কষ্টে শুধু আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তন করবে। তাহলে জীবনের ঊষালগ্নের এ শিক্ষা জীবনের শেষ পর্যন্ত তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করবে।
১৭. দ্বীনি ইলম শিক্ষা দেয়া: ইসলামী শরী’আতে সন্তানকে দ্বীনি ইলম শিক্ষা দেয়া ফরজ করা হয়েছে। কারণ দ্বীনি ইলম না জানা থাকলে সে বিভ্রান্ত এবং ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত হবে।
১৮. নামায শিক্ষা দেয়া ও নামায আদায়ে অভ্যস্ত করা।
১৯. দ্বীনের পথে পরিচালিত করা: সন্তানদেরকে দ্বীনের পথে, কুরআন-সুন্নাহর পথে পরিচালনা করা, দ্বীনের বিধান পালনের ক্ষেত্রে অভ্যস্ত করা ও সুন্নাতের অনুসারীকরে গড়ে তোলা মাতা-পিতার উপর অন্যতম ফরয।
২০. আদব বা শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া।
২১. শরীরচর্চামূলক খেলাধুলা করতে উৎসাহ দেওয়া: সন্তানদের দৈহিক ও মানসিক বিকাশ ও শক্তি অর্জনের জন্য তাদের শরীরচর্চামূলক খেলাধুলা করাতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
২২. ইসলাম অনুমোদন করে না এমন  কাজ থেকে বিরত রাখা: কুরআন-হাদীসের একটি মৌলিক শিক্ষা হল, আচার-ব্যবহার, সাজসজ্জা, কৃষ্টি-কালচার ইত্যাদিতে ইসলামী স্বতন্ত্রবোধ থাকা। এসব ক্ষেত্রে বিজাতীয় অনুকরণকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
২৩. হেকমতের সাথে অন্যায়ের সংশোধন করা: প্রত্যেক ছোটখাট দোষ-ত্র“টিতে তাদের প্রতি রাগান্বিত হলে এবং তাদেরকে বকাবকি করলে এই অন্যায় কাজে তাদের সাহসিকতা বৃদ্ধি পাবে এবং তখন তারা প্রকাশ্যভাবে অন্যায় কাজ করতে থাকবে। এজন্য বুদ্ধিমত্তার সাথে অন্যায়ের সংশোধন করা।
২৪. সব জেদ পুরা না করা:  সন্তানের সব জেদ পুরা না করা। কারণ তাতে অভ্যাস ও স্বভাব খারাপ হয়ে যাবে। জিদ ও হটকারীতার অভ্যাস প্রশ্রয় পাবে। তবে তাদের সব কথাকে অগ্রাহ্য না করা, বুঝিয়ে বলা। অনর্থক বকাঝকা না করা ।     
২৫. গালমন্দ ও অভিশাপ না দেওয়া: কিছু মাতা-পিতা সন্তানের বাড়াবাড়ীমূলক কাজে কিংবা অসমীচীন কোন কর্মকান্ডে ক্রুদ্ধ হয়ে সন্তানকে গালমন্দ ও অভিশাপ দিয়ে থাকে; এটা অত্যন্ত খারাপ কাজ। কেননা, এটা কারো জানা নেই যে, কবুলিয়্যাতের সময় কোনটি? আল্লাহ না করুন যদি বদদু’আ বা অভিশাপ কবুল হয়ে সন্তানের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায় অথবা তার কোন ক্ষতি হয়, তো সারা জীবন নিজেকেই আফসোস করতে হবে।
২৬. দো’আ করা, মহান আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে দো’আ শিক্ষা দিয়েছেন এভাবে,
‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে। আর আপনি আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দিন। (সূরা আল ফুরকান:৭৪)
‘হে আমার রব, আমাকে আপনার পক্ষ থেকে উত্তম সন্তান দান করুন। নিশ্চয় আপনি প্রার্থনা শ্রবণকারী’। (সূরা আলে ইমরান : ৩৮)
মহান আল্লাহ তা’য়ালা সন্তানের যথার্থ কল্যাণ কামনার মাধ্যমে আমাদের তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করার তৌফিক দান করুন, অমিন। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। 
সংকলক : লেখক ও গবেষক।