খুলনা | শনিবার | ১০ মে ২০২৫ | ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

‘তৈলবাজী ভিক্ষাবৃত্তির চেয়েও নিকৃষ্ট’

এড. এম মাফতুন আহমেদ |
০১:৩৫ এ.এম | ০৯ অগাস্ট ২০২৩


প্রবন্ধটি লিখতে যেয়ে একটু পেছনে ফিরে যেতে হয়। স্মরণ করিয়ে দেয় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কথা। আজ থেকে শত বছর পূর্বে ‘তৈল’ রচনাটি তিনি লিখেছিলেন। এ রচনাটিতে সমসাময়িক সমাজ ব্যবস্থার অধঃপতিত চিত্রটি চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। শাস্ত্রী মহাশয় তার রচনাটিতে উলে­খ করেন যে, ‘বাস্তবিক তৈল সর্ব শক্তিমান, যা বলের অসাধ্য, যা বিদ্যায় অসাধ্য, যা কৌশলের অসাধ্য তা কেবল তৈল দ্বারা সিদ্ধ হতে পারে’। 
তিনি আরও লেখেন-‘যে তৈল দিতে পারবে তার বিদ্যা না থাকলেও প্রফেসর হতে পারে। আহম্মক হলেও ম্যাজিস্ট্রেট হতে পারে, সাহস না থাকলেও সেনাপতি হতে পারে। দুর্লভ রাম হয়েও উড়িষ্যার গভর্ণর হতে পারে’। 
ব্রিটিশ ভারতে ১৮৭৭ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর জন্ম হয়েছিল। তিনি আজ পরপারে। ১৯৩১ সালে তার মৃত্যু হয়েছে। তিনি আজ বেঁচে থাকলে আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় তৈল মর্দনকারিদের অপ্রতিরোধ্য আনাগোনা দেখে হয়তোবা কষ্ট পেতেন। কোন কোন ক্ষেত্রে বিস্মিত এবং হতভম্ব হতেন। 
স্ব-জাতির করুণ দশা দেখে লজ্জা পেতেন। আক্ষেপ করে অনেক কিছু বলতেন। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে আরও অনেক কিছু লিখতেন।
জীবনের এই মধ্যবেলায় পথে-প্রান্তে কম-বেশি ঘুরেছি। আমজনতার সাথে মিশেছি। জীবনের বাঁকে বাঁকে কিছু দেখেছি। পালিশ-মালিশবাজদের দেখার সুযোগ পেয়েছি। বিস্ময়ের সাথে চাটুকার, মোসাহেববাজদের লক্ষ্য করেছি। অনেক কিছু উপলব্ধি করেছি। ক্ষুদ্র স্বার্থের বিনিময়ে এরা কী না করতে পারে?
জীবনকে বিকিয়ে দিতে পারে। সহোদর ভাইকে খুন করতে পারে। বন্ধুকে অপহরণ করতে পারে। পদ-পদবির জন্য দেশকে বিμি করতে পারে। আত্মসম্মান বিকিয়ে দিতে পারে। রাতকে দিন, দিনকে রাত বানাতে পারে। ডিগবাজি দিতে পারে। কিছু সুবিধা পাবার আশায় তৈল ঢালতে পারে। মালিশ করতে পারে। পালিশ দিতে জানে। বিত্তবৈভব টিকিয়ে রাখার জন্য মোসাহেবি করতে পারে। 
বাঁকা পথে কিছু পাবার আশায় অন্যের শরীরে তৈল মালিশ-পালিশ করতে পারে। এরা আবার সালাম-কদমবুচিতে সবার আগে। তৈল কত প্রকার এবং কী কী এরা সবই জানে। কোন অঙ্গে তৈল মর্দন করতে হবে, কখন কোন সময়ে সবই তাদের নখদর্পনে। এসব তৈলবাজরা ব্যক্তিত্বহীন, নিলজ্জ, বেহায়া। এক কথায় কপট। 
এসব দেখি আর বলি, নীরবে-নিভৃতে অনেক কিছু ভাবি। একদিন সত্যের জয়গানে যারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন, একটি দিশাহীন জাতির হাতে সত্যের ঝান্ডা তুলে দিয়েছিলেন তাদের প্রয়োজনীতা আজ শেষ। তারা আজকের এই সমাজ-সভ্যতায় অপাংক্তেয়, অসহায়, অর্থব, নিঃস্ব, সহায়, সম্বলহীন। হাতে গোনা যে ক’জন প্রতিবাদী আছেন তারা নীরব, নিথর, নিস্তব্ধ। গোটা সমাজ আজ বাজিকর, মোসাহেববাজ, ব্যক্তিত্বহীনদের দখলে। তারা সমাজের আশে-পাশে কিলবিল করছে। অসত্যের ঢঙ্কা ছড়াচ্ছে। সততা তাদের কাছে বড় বলাই। তারা জানে সততা আজকে বড় কথা নয়, তৈল মালিশই একমাত্র মন্ত্রের সাধন। ধন-মান বৃদ্ধির মোক্ষম বাসন। এদেশে সত্য বাবু অনেক আগেই মারা গেছেন। সততা অনেক আগেই সমাজ থেকে নির্বাসনে চলে গেছে। মোসাহেব, চাটুকার, ধান্দাবাজ, ধাপ্পাবাজ, দুর্বৃত্তের দল সর্বত্রই। তারা গোটা দেশ জাতিকে জিম্মি করে রেখেছে। এসব জো-হুকুমের দল কোন যুগে না ছিল। যুগে যুগে সব আমলেও ছিল। দেশে দেশে সব জায়গায় এখনও আছে। 
ভবিষ্যতেও থাকবে। মোগল আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশে চাটুকার মুষিকের কোন কমতি নেই। তবে একটু পার্থক্য। কম আর বেশি। কেউ স্বাধীনতাত্তোর মুজিবকোট, কালো গ্লাস আর সাফারির তকমা পরেছেন। ব্যক্তি আভিজাত্যকে ধ্বংস করেছেন। অন্ধ স্বার্থের মোহে ব্যস্ত থেকেছেন। ধন-মান বাড়িয়েছেন। নিজের মান ইজ্জতকে বিকিয়ে দিয়েছেন। যা খুশি তাই করেছেন। 
লেখক : খুলনা জেলা ও দায়রা আদালতের আইনজীবী, পাক্ষিক আজাদ বার্তার সম্পাদক ও প্রকাশক।