খুলনা | শনিবার | ১০ মে ২০২৫ | ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

‘দেশপ্রেমের কোন বিকল্প নেই’

এড. এম মাফতুন আহমেদ |
০১:০২ এ.এম | ১২ অগাস্ট ২০২৩


আরবি ভাষায় একটি প্রবচন আছে, ‘আল্ হব্বুল ওয়াতান মিনাল ঈমান, ’অর্থাৎ ‘দেশপ্রেম ঈমানের একটি অপরিহার্য অঙ্গ’। প্রাচীন রোমান কবি ভার্জিল বলে গেছেন, ‘সেই সবচেয়ে সুখী, যে নিজের দেশকে স্বর্গের মতো ভালোবাসে’। যুগে যুগে, দেশে-দেশে প্রকৃত রাজনীতিকদের দেশপ্রেম নিয়ে কোনদিন কোন প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। 
এই উপমহাদেশে শেরে বাংলা থেকে শুরু করে সোহরাওয়ার্দ্দী পর্যন্ত ত্যাগী নেতৃত্বের দেশপ্রেম নিয়ে কোনদিন কোন বিতর্ক শোনা যায়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে মওলানা ভাসানী-বঙ্গবন্ধু-জিয়া দেশের প্রতি ছিলেন প্রশ্নাতীত ভালোবাসা। গভীর শ্রদ্ধা। প্রকৃত অর্থে তারা ছিলেন দেশপ্রেমিক। ছিলেন  পৌঢ় খাওয়া রাজনীতিক। দেশকে নিয়ে তারা বিকিকিনি খেলেননি, বিদেশী কোন শক্তির হাতে দেশ তুলে দেবার চেষ্টা করেননি। জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। আজকের প্রেক্ষাপটে যারা রাতারাতি রাজনীতিক সেজেছেন তাদের নিয়ে বাজারে অনেক চাউর রয়েছে। 
রাজনৈতিক বোদ্ধা মহলের অভিমত, তারা ক্ষমতাকে আঁকড়ে রাখার অভিপ্রায়ে দেশকে বিক্রি করে দিতে সামান্য কুণ্ঠাবোধ করেন না। কাজী লেন্দুপ দর্জি সাজতে মোটেই সময় লাগে না। দেশে-বিদেশের মাটিতে নানা ইস্যুকে সামনে রেখে ষড়যন্ত্র করতে দ্বিধা করেন না।
এবার দেখা যাক সমকালীন প্রেক্ষাপটে রাজনীতিকদের দেশপ্রেম নিয়ে কিছু কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিনগুলোর ঘটনা। প্রবন্ধটি লিখতে যেয়ে প্রসঙ্গত অতীত দিনের কিছু কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইংল্যান্ডের নির্বাচনে চার্চিলের পরাজয় ঘটলে সকলেই বিস্মিত হয়েছিল। যুদ্ধের সময়ে চার্চিলের নেতৃত্ব ছিল অনন্য। উপখ্যানের নায়ক ছিলেন তিনি। মিত্রশক্তির কাছে তিনি একজন দিক নির্দেশক। তার সঠিক নেতৃত্ব, মেধা আর অসীম সাহসের জন্যই সেদিন মিত্রশক্তির বিজয় ঘটেছিল। 
তাই নির্বাচনে পরাজয়ের পর চার্চিল অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু জনগণের রায় মেনে নিয়েছিলেন দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে। এরপর তিনি ঘর থেকে বড় একটা বের হতেন না, কারো সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতেন না। নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গি করেই তিনি দিন কাটাচ্ছিলেন। এমনি অবস্থায় তার বন্ধু আইজেনহাওয়ার তাকে চিঠি লিখলেন আমেরিকা সফরের জন্য। চিঠি পেয়ে চার্চিল খুশি হয়েছিলেন। 
তারপর আমেরিকান মুল­ুকে গিয়েছিলেন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। আমেরিকান মুল­ুকে চার্চিল আসছেন শুনে হাজার হাজার মানুষ তাকে দেখতে ভিড় করেছিল। বহু সাংবাদিক এসেছিলেন সাক্ষাৎকার নিতে। চার্চিলকে কাছে পেয়ে তারা তাকে ঘিরে ধরলেন। হাজার প্রশ্ন করতে শুরু করলেন একেকজন। কেউ জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি বৃটেনের জন্য এত কিছু করলেন আর বৃটেনের মানুষ জনতার জবানবন্দি ৮৫ নির্বাচনে আপনাকে প্রত্যাখান করলো কেন? কেউ জানতে চাইলেন, বৃটেনের মানুষ কী অকৃতজ্ঞ! কেউ বা বললেন, নির্বাচনে পরাজয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী? 
চার্চিল অনেকক্ষণ সাংবাদিকদের প্রশ্নগুলো শুনলেন। কিন্তু কারো প্রশ্নের কোন উত্তর দিলেন না। পরিশেষে বললেন, সাংবাদিক বন্ধুরা, আমেরিকান মুল­ুকে আমার পুরনো বন্ধুর কাছে আমি বেড়াতে এসেছি। এটি আমার ব্যক্তিগত সফর। এ অবস্থায় আমার দেশ ও দেশের মানুষ সম্পর্কে আমি কোন কথা বলবো না। তাতে আমার দেশের অসম্মান হবে। আমার দেশের মানুষ আমার প্রতি অবিচার করেছে বলে মনে হলেও দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে, যুদ্ধ বিধ্বস্ত বৃটেনকে গড়ে তুলতে যা দরকার তারা তাই করেছে। তাদের সে সিদ্ধান্ত আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নিয়েছি। এটাই গণতন্ত্রের রায়। আবার যদি কোনদিন ডাক আসে, দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বো। কিন্তু দেশের সম্পর্কে, দেশের মানুষ সম্পর্কে কোন বিরূপ মন্তব্য করতে পারবো না। ক্ষমা করবেন। সবাই স্তম্ভিত হয়েছিলেন। 
চার্চিলের দেশপ্রেম, গণতন্ত্রের কথা ভেবে সেদিন সকল সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবীরা মুগ্ধ হয়েছিলেন। এসব সভ্য জাতির আদর্শ। সবার জন্য অনুকরণীয়, কিছু শিক্ষাণীয়। 
আমাদের মুক্তি সংগ্রামের যারা পথিকৃত তাদের দেশপ্রেম ছিল, দেশের মানুষের প্রতি একরাশ ভালবাসা ছিল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিব ১৯৭০ সালে অক্টোবর মাসে সাবেক মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাডকে বিদেশ নীতির প্রশ্নে বলেছিলেন, “আমি ভারতপন্থী নই, আমেরিকানপন্থী বা চীনপন্থী নই। আমি আমার জনগণপন্থী”। তিনি কত দেশপ্রেমিক ছিলেন। একবার তিনি বলেছিলেন, “তোমরা কারা আমেরিকার টাকা খাও, কারা ভারতের টাকা খাও এবং কারা পাকিস্তানের টাকা খাচ্ছ সবই এখন আমার জানা। আমার শুধু একটা কথা, টাকা খাও আপত্তি নেই, কিন্তু দেশের স্বার্থ বিক্রি করো না”। মাওলানা ভাসানী। যিনি ছিলেন মজলুমের নেতা। দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে আজীবন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। দেশে-জাতিকে নিয়ে কোনদিন ষড়যন্ত্র করেননি। অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি। 
শহীদ জিয়া। কত বড় জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক নেতা ছিলেন যা আজকের এই দিনে শত্র“-মিত্র অনেককে ভাবিয়ে তোলে। মৃত্যুর পূর্ব দিন ১৯৮১ সালের ২৯ মে তার আত্মপ্রত্যায়ী দীপ্তকণ্ঠটি আমার কানে আজও বেজে ওঠে। তালপট্টি দ্বীপের অমীমাংসিত প্রশ্নে তখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আন্দোলন-সংগ্রাম চলছে। চট্টগ্রামে শহীদ জিয়ার এটাই শেষ দিন; এটাই ছিল শেষ কর্ম দিন। নির্মম বুলেটের আঘাতে পিষ্ট হয়ে তিনি এখানে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। 
সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘মিঃ প্রেসিডেন্ট তালপট্টি নিয়ে কী চিন্তা ভাবনা করছেন? মরহুম প্রেসিডেন্ট সেদিন দৃঢ়তার সাথে বলেছিলেন, ‘তালপট্টি আমার, এক ইঞ্চি জায়গা থেকে আমি সরে আসব না। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে শরণাপন্ন হবো। ন্যায্য হিস্যা আদায় করে ছাড়বো’। 
সেই তালপট্টি দ্বীপ আজ হাতছাড়া। আমাদের ভূ-খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। এর থেকে দুর্ভাগ্য একটি স্বাধীন জাতির জীবনে আর কী হতে পারে? মহান পথিকৃতদের এ সব দেশপ্রেম কী অনুপম আদর্শের মধ্যে পড়ে না? আমরা কী এ সব অনুপম আদর্শ অনুসরণ করতে পারি না? 
লেখক : খুলনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী, পাক্ষিক আজাদ বার্তার প্রকাশক ও সম্পাদক।