খুলনা | বুধবার | ১৫ জানুয়ারী ২০২৫ | ২ মাঘ ১৪৩১

স্ত্রীর প্রতি স্বামীর করণীয়

ড. মুহাম্মদ বেলায়েত হুসাইন |
০১:১৬ এ.এম | ১২ অগাস্ট ২০২৩


স্বামী-স্ত্রী। পৃথিবীর সবচেয়ে আপন এবং মধুর একটি বন্ধনের নাম। মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, ‘তারা তোমাদের পোশাক আর তোমরা তাদের পোশাক।’ নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নারীরা পুরুষের অর্ধাংশ। অর্থাৎ সৃষ্টিগত কৌশলতায় একজনকে করেছেন অপরজনের সহায়ক। মহান আল্লাহ তা’য়ালা বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে নারী ও পুরুষের মধ্যে সৃষ্টি করে দিয়েছেন পারস্পরিক আকর্ষণ এবং একের সাথে অপরের সুখময় জীবনযাপনের রাস্তা। বিবাহ শুধুমাত্র শরী’আতি ব্যবস্থা বা আইনের বিধান নয়। আইনের ঊর্ধ্বে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম ও ভালবাসার সম্পর্ক সৃষ্টির মাধ্যম। এই ভালবাসা মহান আল্লাহ তা’য়ালা মেহেরবানী করে মানব-মানবীর হৃদয়ে সৃষ্টি করে দিয়েছেন।
স্ত্রীকে দুনিয়া ও আখিরাতে সত্যিকারের প্রেম ও ভালবাসার উৎস বানাতে আমাদের রয়েছে অনেক দায়িত্ব। এ বিষয়ে ইসলামে যে নির্দেশনা রয়েছে তা সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করব, ইনশাল্লাহ্।
১. মোহর আদায় করা: স্ত্রীর সাথে ন্যায়সঙ্গত আচরণের অন্যতম হচ্ছে তার মোহর যথাযথ আদায় করা।
২. স্ত্রীর সাথে সর্বদা উত্তম আচরণ করা: রসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘ঈমানওয়ালাদের মধ্যে পরিপূর্ণ মুমিন সেই ব্যক্তি, যার আচার-আচরণ উত্তম। আর তোমাদের মাঝে তারাই উত্তম যারা আচার-আচরণে তাদের স্ত্রীদের কাছে উত্তম। (তিরমিযি)
৩. সামান্য দোষ-ত্র“টি উপেক্ষা করা: দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই একে অপরের সামান্য দোষ-ত্র“টি উপেক্ষা করে সৎ গুণাবলীর প্রতি আকৃষ্ট হওয়া প্রয়োজন। সামান্য বিষয় নিয়ে স্ত্রীর সাথে ঝগড়া-বিবাদ না করা। কথায় কথায় ধমক না দেওয়া। রাগ না করা।
৪. দোষ-ত্র“টি ক্ষমা করা: অল্পতেই রেগে যাওয়া, অভিমানে ক্ষুব্ধ হওয়া, স্বভাবগত অস্থিরতায় চঞ্চলা হয়ে উঠা এবং স্বভাবের বক্রতা নারী চরিত্রের বিশেষ দিক। এজন্য দাম্পত্য জীবনকে সুখময় করে তুলতে স্বামীর উচিৎ হবে এই ত্র“টিগুলোকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা না করা।
৫. স্ত্রীর কোন দুর্বলতাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে স্ত্রীর মনে কষ্ট না দেয়া: স্ত্রীর মধ্যে এমন কিছু পাওয়া যেতে পারে যা স্বামীর পছন্দনীয় নয়। এজন্য স্বামীকে হতে হবে উদার চিত্তের অধিকারী।
৬. অযথা সন্দেহ না করা। ৭. স্ত্রীর আত্মমর্যাদায় আঘাত করে এমন বিষয়ে সংযত থাকা। ৮. স্ত্রীর কোনো কথায় বা কাজে কষ্ট পেলে ধৈর্য্য ধারণ করা। ৯. উচ্ছৃঙ্খল, বেপর্দা চলাফেরা করতে থাকলে নম্র ভাষায় তাকে বোঝানো।
১০. স্ত্রীর সম্পর্কে উদাসীন না থাকা তার মনোরঞ্জনের প্রতি লক্ষ্য রাখা: নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে হযরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহাকে গল্প শোনাতেন, তাঁর সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করতেন, সাথে নিয়ে পানাহার করতেন।
১১. সামর্থ্যনুযায়ী প্রয়োজন মাফিক থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা: ইসলামের অধিকার আইনে পরিবারের ভরণ-পোষণ বা অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব ন্যস্ত রয়েছে পুরুষের ওপর। ইসলাম স্বামীকে তার স্ত্রীর খাবার, পোশাক পরিচ্ছদ, বাসস্থান এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র সরবরাহ করার নির্দেশ দিয়েছে। ১২. ঈমান শিক্ষা দেয়া। ১৩. দ্বীনি ইলম শিক্ষা দেয়া ।
১৪. দ্বীনের পথে পরিচালিত করা: স্ত্রীকে দ্বীনের পথে, কুরআন-সুন্নাহর পথে পরিচালনা করা, দ্বীনের বিধান পালনের ক্ষেত্রে অভ্যস্ত করা ও সুন্নাতের অনুসারী করে গড়ে তোলা স্বামীর উপর অন্যতম দায়িত্ব।
১৫. শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় সাহায্য করা: ইসলাম নারীদেরকে পুরুষের ন্যায় ধর্মীয় ও বৈষয়িক জীবনে শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অধিকার দিয়েছে। রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের (নর-নারী) জন্য বিদ্যা অর্জন করা ফরয’। (ইবনে মাজাহ)
১৬. স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার দেওয়া: ইসলাম পূর্বে নারীদের ছিলনা কোন বাক স্বাধীনতা। নারী কোন বিষয়ে সমালোচনা করবে, পরামর্শ দেবে বা পুরুষের ভুল শুধরে দেবে এ কথা কল্পনাই করা যেত না।  ইসলামই সর্বপ্রথম নারীকে দান করেছে এই মত প্রকাশের স্বাধীনতা। এজন্য সংসারের সর্বক্ষেত্রে তারা যেন স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারে সে পরিবেশ তৈরি করা।
১৭. শরী’আত পরিপন্থী কাজ অর্থাৎ ইসলাম অনুমোদন করে না এমন কাজ থেকে বিরত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা।
১৮. একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদের মাঝে ইনসাফ তথা সমতা রক্ষা করা।
১৯. স্ত্রীর পিতা-মাতা, ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে ভাল ব্যবহার করা।
২০. চাহিদানুযায়ী তাদের সাথে মেলামেশা করা: নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন পুরুষ তার স্ত্রীর সাথে সহবাস করে তখন সে যেন পরিপূর্ণভাবে (সহবাস) করে। আর তার যখন চাহিদা পূরণ হয়ে যায় (শুক্রস্খলন হয়) অথচ স্ত্রীর চাহিদা অপূর্ণ থাকে, তখন সে যেন তাড়াহুড়া না করে। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক)
২১. অনুমতি ব্যতীত আযল অর্থাৎ মেলামেশার সময় শেষ মুহূর্তে স্বাভাবিক স্থান ত্যাগ না করা। ২২. স্ত্রীর সাথে মেলামেশার চিত্র অন্যের কাছে বর্ণনা না করা।
২৩. মাঝে মাঝে স্ত্রীর মাতা-পিতা ও নিকটাত্মীয়দের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করার সুযোগ করে দেওয়া।
২৪. প্রয়োজনে স্ত্রীকে শাসন করা, সতর্ক করা: প্রয়োজনে শরীয়ত যতটুকু অনুমতি দিয়েছে তার চেয়ে বেশি হাত না তোলা।
২৫. একান্ত নিরুপায় না হলে তালাক না দেওয়া এবং প্রয়োজনের ক্ষেত্রে শরী’আত-গৃহীত পন্থায় তালাক দেওয়া। ২৬. ঘরের কাজ-কর্মে স্ত্রীকে সাহায্য সহযোগিতা করা।
২৭. শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করতে বাধ্য না করা: স্বামীর এই অধিকার নেই যে, সে স্ত্রীকে তার পিতা-মাতার সেবা করতে বাধ্য করবে। তবে পুত্রবধূ সন্তুষ্টচিত্তে সৌভাগ্য মনে করে স্বামীর পিতা-মাতার যতটুকু সেবা করবে, সে তার প্রতিদান পাবে। এর জন্য প্রয়োজন হলে তাদেরকে উৎসাহিত করা যেতে পারে।
২৮. কৃতজ্ঞ হওয়া: স্ত্রীর প্রতি ন্যায়সঙ্গত আচরণের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো স্ত্রীর প্রতি ওয়াফাদারিতা, অর্থাৎ কৃতজ্ঞতা ও কৃতার্থতা- শুধু জীবদ্দশায়ই নয়, মৃত্যুর পরও।
২৯. সম্পদে উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা করা: উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত স্বামীর সম্পদে স্ত্রীর অধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা।
৩০. দো’আ করা: মহান আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে দো’আ শিক্ষা দিয়েছেন এভাবে,
‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে। আর আপনি আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দিন। (সূরা আল ফুরকান:৭৪)
মহান আল্লাহ তা’য়ালা স্ত্রীর যথার্থ কল্যাণ কামনার মাধ্যমে আমাদের তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ। লেখক: বায়োকেমিস্ট, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়, খুলনা।