খুলনা | বুধবার | ২৩ অক্টোবর ২০২৪ | ৮ কার্তিক ১৪৩১

১২ বছরে ফাঁস হওয়া প্রশ্নে ভর্তি শত শত, খুলনা মেডিকেলে ২০ শিক্ষার্থী!

খবর ডেস্ক |
১২:৫৭ এ.এম | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩


ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে নামী দামী মেডিকেল কলেজেও ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন শত শত শিক্ষার্থী। ২০০৬ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন বছরে এ প্রশ্ন ফাঁস হয়। এসব প্রশ্ন কিনে পরীক্ষা দিয়ে দেশের প্রথম সারির মেডিকেল কলেজগুলোর সাথে খুলনা মেডিকেল কলেজেও ভর্তি হওয়ার সুযোগ মিলে যায়। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির তদন্তে চিকিৎসা শিক্ষার এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।
তদন্ত সংস্থা সিআইডি এরই মধ্যে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে মেডিকেলে ভর্তি হওয়া দুই শতাধিক শিক্ষার্থীকে চিহ্নিত করেছে। প্রশ্নপত্র কিনে ভর্তি হওয়া এ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এখন পর্যন্ত খুলনা মেডিকেল কলেজে ২০ শিক্ষার্থীকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন কলেজে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ফলও সংগ্রহ করছে সিআইডি। স¤প্রতি খুলনা মেডিকেল কলেজের সাবেক তিন শিক্ষার্থীকে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয়।
জানা গেছে, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কিনে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ৪০, খুলনা মেডিকেল কলেজে ২০, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে ২৫, স্যার সলিমুল­াহ মেডিকেল কলেজে ২০ ও রংপুর মেডিকেল কলেজের ১৫ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। ইতোমধ্যে তাদের চিহ্নিত করেছে সিআইডি। একাধিক অভিযুক্তকে রাখা হয়েছে নজরদারিতে।
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, ২০০৬ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মেডিকেলের প্রশ্নফাঁসে জড়িত চক্রের ৩২ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ, উদ্ধার হওয়া ব্যাংক চেক, ডিজিটাল আলামত বিশ্লেষণ করে এই শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে তথ্য পাওয়া গেছে। গ্রেফতার ওই ব্যক্তিদের মধ্যে ১২ জন চিকিৎসক রয়েছেন।
সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, তদন্তে অনেক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। সেসব শিক্ষার্থীর বিষয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য জোগাড়ে কাজ চলছে। বিভিন্ন মেডিকেলে চিঠি পাঠানো সেই কাজেরই অংশ। অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। সেগুলো যাচাই করা হচ্ছে।
মেডিকেল কলেজে প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় দায়ের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমা বলেন, তদন্তে অনেক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। সেসব শিক্ষার্থীর বিষয়ে আরো বিস্তারিত তথ্য জোগাড়ে কাজ চলছে। বিভিন্ন মেডিকেলে চিঠি পাঠানো সেই কাজেরই অংশ। অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। সেগুলো যাচাই করা হচ্ছে।
২২ মেডিকেল শিক্ষার্থী : ঢাকা মেডিকেল কলেজে এবং খুলনা মেডিকেল কলেজে পাঠানো পৃথক দু’টি চিঠিতে ২২ শিক্ষার্থীর নাম পাওয়া গেছে, যাদের মধ্যে খুলনা মেডিকেলে তিন শিক্ষার্থীকে এরই মধ্যে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। অন্যদের সিআইডির নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
তালিকায় থাকা খুলনা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইতোমধ্যে গ্রেফতার হওয়া পিরোজপুরের মুসতাহিন হাসান লামিয়া ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে মেধা তালিকায় ১১তম হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন । তিনি প্রথম প্রফেশনাল পরীক্ষায় ২০১৭ সালে অ্যানাটমি ও ফিজিওলজিতে ফেল করেন। দ্বিতীয় প্রফেশনাল পরীক্ষা ২০১৮ সালে মেডিসিনে ফেল করেন। তবে ২০২১ সালে চূড়ান্ত প্রফেশনাল পরীক্ষায় পাস করেন।
খুলনার শর্মিষ্ঠা মণ্ডল ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ১৮২৩তম হয়ে ভর্তি হন। পাস করেছেন ২০২২ সালে। খুলনার নাজিয়া মেহজাবীন ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ১৩৫৬তম হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। পাস করেছেন ২০২১ সালের মে মাসে। 
এর আগে গত ২০ আগস্ট প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেফতার করে সিআইডি। তাদের মধ্যে এ তালিকায় রয়েছেন তিনজন। তারা হলেন নাজিয়া মেহজাবীন, শর্মিষ্ঠা মণ্ডল ও মুসতাহিন হাসান লামিয়া।
মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ছাত্রদের কাছে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার অভিযোগে থ্রি ডক্টরসের মালিক ডাঃ মোঃ ইউনুচ উজ্জামান খান তারিমকে গ্রেফতার করে সিআইডি। 
খুলনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডাঃ মোঃ দীন-উল ইসলাম বলেন, ‘১১ শিক্ষার্থীর নাম দিয়ে তাদের একাডেমিক বিষয়ে তথ্য চেয়েছিল সিআইডি। আমরা সঙ্গে সঙ্গে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে পাঠিয়েছি। আমরা যখন সিআইডিকে তথ্য পাঠিয়েছি, তখন আটজন পাস করে বের হয়েছে, তিনজনের ফল প্রকাশ তখনো বাকি ছিল। তারা সময়মতো পাস করতে পারে নাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কেউই এই বিষয়টা সমর্থন করি না। যেখানে একটা ছেলে মেয়ের সারা জীবনের স্বপ্ন থাকে যে, সে মেডিকেলে পড়বে। ছোটবেলা থেকেই সেভাবে প্রস্তুতি নিতে থাকে। অনেক পরিশ্রম করতে হয় তাদের। এই অবস্থায় কেউ ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কিনে তাকে বাইপাস করে এগিয়ে যায়, ভর্তি হয়, এটা কোনো ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এখন যদি ১০ জন ছাত্রও এভাবে ভর্তি হয়, তাহলে ১০ জন মেধাবী ছেলে বঞ্চিত হয়। অবশ্যই তাদের শাস্তি দেওয়া উচিত। তবে যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে তাদের হাতে তুলে দিয়েছে, তাদের আরও কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত।’
সিআইডির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ফাঁসের মূল মাস্টারমাইন্ড জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া মুন্নু। তাকে প্রশ্নপত্র বের করে দিতেন স্বাস্থ্য-শিক্ষা ব্যুরোর প্রেসের মেশিনম্যান আব্দুস সালাম। প্রশ্ন পাওয়ার পর সারাদেশে থাকা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিক্রির কাজটি করতেন জসিম। সালাম-জমিসের সিন্ডিকেটে তাদের পরিবারের সদস্যরাও জড়ায়। সঙ্গে যুক্ত হয় নামিদামি মেডিকেলে ভর্তি কোচিংয়ের মালিক ও শিক্ষকরা। তাদের মাধ্যমেই সারাদেশে প্রশ্নপত্র বিক্রি করে আসছিলো চক্রটি। সর্বশেষ ২০১৫ সালে মেডিকেল ও ২০১৭ সালে ডেন্টালের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে বলে জানিয়েছে সিআইডি। এরপর আর প্রশ্নফাঁস করতে পারেনি এ চক্রটি।
প্রশ্নফাঁস ও বিক্রির সঙ্গে সরাসরি জড়িতদের গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে সিআইডি জানিয়েছে, প্রশ্নফাঁসের চুক্তি হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা গ্যারান্টি হিসেবে অভিভাবকের ব্যাংক এ্যাকাউন্টের চেক দিতেন। কারও কাছে ১৫ লাখ, কারও কাছ থেকে ১০ লাখ টাকার চেক নেয়া হতো। চেক দিতে না পারলে ভর্তি পরীক্ষার্থীর মূল সনদ বা নম্বরপত্র রেখে দিতো চক্রের সদস্যরা। এছাড়া প্রায় সবারই মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেয়া পিন নম্বর সংগ্রহ করে রাখতো চক্রটি, যাতে এ্যাডমিট কার্ড তারা নিজেরাই ডাউনলোড করতে পারে এবং সেই শিক্ষার্থী কোন মেডিকেলে চান্স পেলো, সেটি জানতে পারে। পুরো কাজটি খুব নিখুঁতভাবে করা হতো, যাতে চান্স পাওয়ার পর কোনো শিক্ষার্থী অস্বীকার করতে না পারে। সিআইডি তাদের অভিযানে চক্রের সদস্যদের কাছ থেকে সেসব আলামত উদ্ধার করেছে।