খুলনা | বৃহস্পতিবার | ১০ অক্টোবর ২০২৪ | ২৪ আশ্বিন ১৪৩১

“হেডমাস্টার মোহাম্মদ আমজাদ আলী আমার পিতা”

এড. এম মাফতুন আহমেদ |
১২:২০ এ.এম | ২০ অক্টোবর ২০২৩


হেডমাস্টার মোহাম্মদ আমজাদ আলী আমার মরহুম পিতা। আমার আদর্শ, গোটা পরিবারের গর্বের ধন। ২০১২ সালের ২০ অক্টোবর সকাল সকাল ৭ টা ৩০ মিনিটে ৭৮ বছর বয়সে তিনি সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যান এক গহীন অন্ধকারে না ফেরার দেশে। জীবনের প্রতি প্রতিটা ক্ষণে তাঁকে আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। ভেসে উঠে মনের মুকুরে তাঁর অনুপম আদর্শ। যা আজও বুকে ধারণ করে রাখার সাধ্যপর চেষ্টা করি।
তাঁর প্রতিটি আদর্শ আমার জীবনের পাথেয়। তাঁর মৃত্যুবাষির্কীর দিনে অনেক স্মৃতি, অজানা নানা কথা আমার হৃদয়ের মুকুরে ভেসে উঠে। তাঁর জেষ্ঠ্য সন্তান হয়ে মৃত্যুবাষির্কীর এই দিনে কোনটা বাদ দিয়ে কোনটা লিখবো ভেবে ক‚ল পাই না। নিজেকে কিছুটা আবেগে আপ্লুত হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। স্বল্প পরিসরে কিছু লেখা যায় না। তবুও তাঁর সম্পর্কে কিছু লেখা আমার পরম দায়িত্ব এবং সন্তান হিসেবে বিবেকের কর্তব্য। তাই সংক্ষিপ্ত পরিসরে হলেও তাঁর জীবন আলেখ্য কিছু কথা এই জাতি রাষ্ট্রের কাছে তুলে ধরার একান্তভাবে চেষ্টা করবো।
ব্রিটিশ ভারতে আমার আব্বার লেখাপড়ার হাতে খড়ি। তিনি খুলনা জেলা স্কুলের ছাত্র ছিলেন। অজপাড়াগায়ের বিশেষ করে বর্ণ যুগের মধ্যে বসবাস করে জেলা স্কুলে তৎকালীন সময়ে চান্স পাওয়া সত্যিই কঠিন সাধ্য ব্যাপার ছিল। অতঃপর হিন্দু একাডেমি (আজকের বি.এল কলেজ) থেকে তিনি সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছেন। কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছেন। সেদিন আব্বা মনে করলে সুপিরিয়র কোন সার্ভিসে যোগদান করতে পারতেন। সেদিকে না তাকিয়ে তিনি শহর  ছেড়ে ফিরে যান সূদুর মফস্বলে। বেছে নেন মহান শিক্ষকতা পেশা। 
কারণ কী? মণীষী রাসেল বলেছেন, Teachers are the Architect of Nation and Harbinger of civilization শিক্ষকতা কেবল চাকুরি নয়; বরং শিক্ষকতা এক মহান পেশা ও ব্রত। যুগে যুগে, কালে কালে, তাই শিক্ষক জ্ঞানের দীপশিখা জ্বেলেছেন, উজাড় করে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের জ্ঞানের ভান্ডার। অথচ কখনো প্রশ্ন করে দেখেননি প্রতিদানে তিনি কী  পেয়েছেন।  আমার মরহুম পিতা মনে করেছিলেন মনুষ্যত্ব ও মানবিকতা গড়ে না উঠলে একটি জাতি কখনও উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারে না। তাই মানুষ গড়ার কারিগর মহান শিক্ষকতা পেশা বেছে নিয়েছিলেন। 
মানব সেবায় নিজের জীবনকে বিকিয়ে দিয়েছিলেন। কর্মগুণে তিনি জীবনের পরতে পরতে সফলতার পরিচয় নিয়েছিলেন। প্রতিটি মুহূর্তে জঙ্গল পরিস্কার করে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে মনুষ্যত্ব বিকাশে এগিয়ে গেছেন। আসলে  যে কোন সাধনা কখনও বৃথা যায় না। আমার আব্বার সততা, নির্মোহতা কখনও বৃথা যায়নি। খুলনার উপক‚লীয় জনপদের মানুষ তাঁকে আজও সম্মানের আসনে আসীন করে রেখেছেন। কবি বলেছেন,
“উদয়ের পথে শুনি কার বাণী
ভয় নাই ওরে ভয় নাই।
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান,
ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই”।
আশরাফুল মাখলুকাত। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। তাই প্রতিটি মানুষ ভেতরে শ্রেষ্ঠত্ব, মমত্ব, ভালবাসা থাকা উচিত। আর এই শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রধান শর্ত হচ্ছে তাঁর মধ্যে আদর্শ, সততা এবং শৃঙ্খলা। এসব যার মধ্যে অভাব থাকে কী বলা যাবে একজন পূর্ণ মানুষ? তিনি আজ পরপারে। 
আমি সগৌরবে ঘোষণা করতে চাই আমার মরহুম পিতা ছিলেন মানবীয় গুণাবলী সম্পন্ন একজন অসাধারণ সাদাসিধা আদর্শবান মানুষ। সততাই ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে অলঙ্কার। আজ তিনি দক্ষিণ খুলনার একজন আলোকিত মানুষ গড়ার সফল কারিগর হিসেবে আপন মহিমায় মহিমান্বিত। প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন আদর্শিক চেতনা সম্পন্ন সৎ, কর্ম উদ্যোগী সাদা মনের একজন সৃষ্টিশীল কর্মবীর।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত পাইকগাছা গভঃ হাইস্কুল। ১৯৭১-এর মহান মুক্তি সংগ্রামে সেখানে সবকিছু লন্ডভন্ড। তিনি তখন এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ধ্বংসস্তুপ এই স্কুলটির স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাবার জন্য সর্বস্তরের সহযোগিতা চাইলেন। খালি হাতে তাঁকে কেউ ফিরিয়ে দেননি। সবাই সহযোগিতা করলেন উদার মনে। শিক্ষক কর্মচারী সর্বোপরি বিদ্যুৎসাহীদের নিয়ে এগিয়ে গেলেন বিধ্বস্ত স্কুল গড়ার কাজে। পাইকগাছা হাইস্কুল ফিরে পেলো আবার পূর্বের মতো নব যৌবনে। তিনি সৃষ্টি করলেন দেশের দক্ষিণবঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে ইতিহাস-ঐতিহ্য।
আজ স্কুলটি সরকারিকরণ হয়েছে। শিক্ষার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে-বিদেশে সুনাম কুড়িয়েছে। অসংখ্য শিক্ষার্থী কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছেন। যে ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত রয়েছে। এসবের মূলে ছিল আমার মরহুম পিতা জনাব মোহাম্মদ আমজাদ আলীর অসামান্য অবদান।
তিনি ছিলেন নির্লোভ, নির্মোহ একজন সাধারণ মানুষ। দুর্নীতি, অনিয়মের সাথে কখনও আলিঙ্গণ করেননি। অনার্য দাবির কাছে আত্মসমর্পন করেননি। দল-মত সবাইকে নিয়ে চলার চেষ্টা করেছেন। বিবেককে সাক্ষী রেখে যেটা ভাল মনে করেছেন সেভাবে এগয়ে গেছেন। পাইকগাছা হাইস্কুলকে তিনি হৃদয় দিয়ে ভালবাসতেন। প্রায় বলতেন- “এই স্কুল আমার জীবন, এই স্কুল আমার জীবনে এনে দিয়েছে বিরল সম্মান। আমার জীবন থাকতে এই স্কুলের সাথে বেঈমানী করতে পারবো না”।
আব্বা কাউকে বড় করতে যেয়ে জীবনে কখনও কাউকে ছোট করেননি। রাস্তা দিতে যখন হাঁটতেন মাটি কাঁপতো কিনা সন্দেহ। সবসময় বলতেন- “তুমি কাউকে অপমান করো না, করলে নিজেকে একদিন অপমানিত হতে হবে”। স্পষ্টবাদিতাই ছিল তাঁর জীবনের আর একটি দর্শন। ব্যক্তিত্বের প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপোষহীন। মানুষের সেখানে সমস্যা সেখানে তিনি এগিয়ে গেছেন।
আমাদের বাড়ীর আশেপাশে যত রাস্তা হয়েছে এসব রাস্তা নির্মাণে নিজ জমিদান দান করেছেন। উচ্চ পর্যায়ে কর্মরত নিজের হাতে গড়া ছাত্রদের সহযোগিতায় এসব রাস্তাঘাট নির্মাণ, এলাকায় বিদ্যুতায়িত করেছেন। নিজের একটু ক্ষতি হলেও তিনি অপরকে কখনও ক্ষতি হতে দেননি। সবসময় সু-পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি সাহসী এবং দৃঢ়চিত্তের একজন আপোষসহীন মানুষ ছিলেন। শত ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও বন্ধুর মতো আমাদের ভাই-বোন পরিবারবর্গ নিয়ে প্রায় ব্রিটিশ ভারত থেকে শুরু করে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে অনেক অজানা কথা বলতেন।
তাই অতীত দিনের একটি স্মৃতিমূলক কথা বলে আজকের এই নিবন্ধটি শেষ করবো। ইংরেজী ১৯৭৩ সাল। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। পাইকগাছা পরীক্ষা কেন্দ্রে এসএসসি পরীক্ষা চলছে। আব্বা কেন্দ্রের সচিব। তখন জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরীক্ষা কেন্দ্র তদারকির জন্য একজন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করতেন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের নাম কাতেবুর রহমান। বাড়ী সম্ভবত নড়াইল। পরবর্তীতে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার হয়েছিলেন। বলা যায় তিনি ছিলেন কিছুটা খামখেয়ালিপনা। ১৩ জন ছাত্রকে নকলের দায়ে পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে বহিস্কারের জন্য আব্বাকে অনুরোধ করেন। আব্বার বিবেকে ধাক্কা দেয়। এই অনুরোধ খেয়ালিপূর্ণ ছাড়া কিছুই না। ক্ষমতা বলে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের অনুরোধ উপেক্ষা করলেন আব্বা। তখন জেলা প্রশাসক আবু হেনা সাহেব। পরবর্তীতে চীফ নির্বাচন কমিশনার হয়েছিলেন। খুলনায় এক অনুষ্ঠানে কাছে থেকে উনাকে দেখেছি। এক পর্যায়ে জেলা প্রশাসক আব্বাকে কারণ দর্শালেন। আব্বা সহজ সরল ভঙ্গিতে জেলা প্রশাসকের কারণ দর্শানোর জবাব দিলেন। জেলা প্রশাসক মহোদয় বুঝেছিলেন দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেটের কাজ ন্যায়নুগ হয়নি। আব্বার সরলতা, দৃঢ়তা এবং সাহসী পদক্ষেপে সেদিনের উক্ত পরীক্ষার্থীরা বেঁচে গিয়েছিলেন। আজও এ ঘটনা স্মৃতির মানসপটে অনেকের ভেসে উঠে। সত্যিই আমার মরহুম পিতার হয়েছিল বিবেকের বিজয়। মোসাহেবী এই সমাজ ব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে এসব সাহসী পদক্ষেপ আজকের দিনে ক’জন নিতে সাহস রাখেন? বিষয়টি জাতিকে ভাবিয়ে তোলে।
অনেক কথা, অনেক স্মৃতি আজ মনের মুকুরে ভেসে উঠছে। ভেসে উঠে দু’পলকে পাইকগাছা উপজেলা সদর শ্যামল ছায়াঢাকা ‘বাতিখালী’ গ্রামের স্মৃতি বিজড়িত অনেক কথা। শৈশব, কৈশোর এবং পেশাগত জীবনের একটি উলে­খযোগ্য সময়  কেটেছে এই পূণ্য ভ‚মিতে। সবই আজ আছে। কিন্তু আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয়তম পাতাটি মাটির সাথে মিশে গেছে। এটাই নিয়তি। এটাই জীবন খেলা। এটাই আমাকে মেনে নিতে হবে। আমার আব্বার মৃত্যু আমাকে সেদিন শূন্যতার সাগরে ভাসিয়ে দেয়। তাঁর সব স্মৃতিই আজ আমার শূন্যতা পূরণ করেছে। তিনি আজ নেই। কিন্তু যে সহজ সরল জীবনদর্শন রেখে গেছেন তা আমাদের জন্য বড় শিক্ষাণীয়। সেই উদাহরণটা আমার বড় প্রেরণা। যে প্রেরণা আমাকে টেনে এনেছে আজকের এই অবস্থানে। কবির ভাষায় বলতে হয়ঃ
“নয়ন সম্মুখে তুমি নেই
হৃদয়ের মাঝে দিয়েছ ঠাঁই”।
মরহুম পিতা তাঁর কর্মের মাধ্যমে বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন। তাঁর হাতে গড়া এদেশের গণ মানুষের মুখপাত্র আজাদবার্তা নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রকাশ হচ্ছে আজও। তাঁর স্মৃতিকে চিরঞ্জীব রাখার জন্য পাইকগাছা সদরে এবং খুলনা শহরে “হেডমাস্টার আমজাদ আলী পাবরিক লাইব্রেরি এÐরিসার্স ইনস্টিটিউট” এ দেশের একটি অনন্য গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান। যা সরকারি এবং বিভিন্ন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় মাথা উঁচু করে আজও দাঁড়িয়ে আছে। 
লেখক : সিনিয়র আইনজীবী ও আজাদ বার্তা’র সম্পাদক।