খুলনা | শনিবার | ০২ ডিসেম্বর ২০২৩ | ১৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩০

মেজবানের জন্য মেহমানের করণীয়

ড. মুহাম্মদ বেলায়েত হুসাইন |
০২:৩০ এ.এম | ১১ নভেম্বর ২০২৩


আমরা পূর্বের প্রবন্ধে আলোচনা করেছি, কারও বাড়িতে যখন কেউ বেড়াতে আসে তখন তাকে বলা হয় মেহমান। অপরদিকে, বাড়ির অধিবাসীদের বলা হয় মেজবান।
হযরত আলী রাযিয়াল­াহু আনহু বর্ণিত হাদীসে রসূলে কারীম সল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­াম এক মুসলমানের উপর অন্য মুসলমানের ছয়টি হকের কথা বলেছেন। এর মধ্য একটি হল, ‘যখন দাওয়াত দেয় তখন দাওয়াত কবুল করবে।’ (ইবনে মাজাহ)
উপরোক্ত হাদীস হতে আমরা স্পষ্টতই বুঝতে পারছি, ছোট-বড়, ধনী-গরীব, নিকট-দূর, আত্মীয়-অনাত্মীয় ইত্যাদি বিবেচনা না করে দাওয়াত কবুল করাই একটি বড় সুন্নাত।
হযরতে উলামায়ে কেরাম মেজবানের মতো মেহমানেরও কিছু করণীয় ও আদব বর্ণনা করেছেন। সেগুলো নিম্নে উলে­খ করা হল।
১. মেহমানের করণীয় হলো, কোনো ওজর না থাকলে দাওয়াত কবুল করা। ২. বেশী দূর হওয়ার কারণে দাওয়াত গ্রহণে অস্বীকার না করা।
৩. যাওয়ার সময়ের ব্যাপারে বিবেচনা প্রসূত হওয়া, সময়টা আগেই জানিয়ে দেয়া। উপঢৌকন নিয়ে যাওয়া। পুরুষশূন্য বাড়িতে একা না যাওয়া।
৪. কারো বাড়িতে মেহমান হলে খাওয়ার সময়কে বেছে না নেওয়া। এমনভাবে মেহমান হবে, যাতে তারা তার জন্য রান্না করে খাবারের ব্যবস্থা করতে পারে।
৫. যদি খাবার চাহিদা না থাকে তাহলে আগে থেকেই মেজবানকে জানিয়ে দেওয়া যে, ‘আমি খানা খেয়ে এসেছি; এখন খাবনা’।
৬. কারো বাড়িতে প্রবেশের সময় দৃষ্টি অবনত রাখা, যেন ঘরের কোনো নারীর প্রতি দৃষ্টি না পড়ে যায়। ৭. অনুমতি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করা।
৮. মেজবান বসতে বলার আগে না বসা। ৯. গোয়েন্দার মতো অনুসন্ধান না করা। যা যা প্রয়োজন তার মাঝেই চোখকে সীমাবদ্ধ রাখা। সংরক্ষিত ধন-ভান্ডার, ট্রাঙ্ক, ব্রিফকেস, টাকার থলি ও অন্যকোন বস্তু না খোলা।
১০. যে ঘরে বা যে দিকে নারীরা অবস্থান করে সেদিকে মুখ করে না বসা এবং দৃষ্টিপাত না করা। ১১. রান্নাঘর বা খাবার যেখানে তৈরি করে, সেখানে গিয়ে ঘোরাঘুরি না করা। ১২. যে জায়গায় খাদ্য এনে রাখা হয়, সেদিকে না তাকানো। কারণ এটি অধৈর্য ও লোভের পরিচায়ক।
১৩. মেহমান হিসেবে কোথাও গেলে সেখানকার কোন ব্যবস্থাপনায় মেজবানের অনুমতি ছাড়া ব্যবস্থাপক হিসেবে কোন কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা ঠিক নয়। ১৪. খুব বিনয় ও নম্র-ভদ্র হয়ে থাকা। বাড়ীর লোকের অসুবিধা হয় এমন কোনো কাজ না করা।
১৫. মরিচ কম খাওয়ার অভ্যাস থাকলে বা বিশেষ কোন খাবারে অসুবিধা থাকলে মেজবানের বাড়িতে পৌঁছানোর সাথে সাথে তা মেজবানকে অবগত করানো। খানা সামনে আসার পর কোন আপত্তি না করা।
১৬. যে খাবার উপস্থিত হয় শুকরিয়ার সাথে খাওয়া। খাবারের দোষ না ধরে যথাসম্ভব প্রশংসা করা। ১৭. নিজ থেকে খাবারের কোনো পদ ঠিক করে না দেয়া।
১৮. খাওয়ার জন্য কোনো খাবার সামনে পেশ করলে, তাকে তুচ্ছ করবে না। সীমিত খাওয়ার গ্রহণ করবে অধিক পরিমাণে খাবে না।
১৯. একই প্রকার বস্তু হলে শুধু নিজের দিক থেকে খাওয়া, আর যদি বিভিন্ন প্রকারের খাদ্যদ্রব্য হয় তাহলে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খাওয়া।
২০. একাধিক সাথী একই প্লেটে খানা খেলে অপরের যেন কোন প্রকার অসুবিধা না হয় সেদিকে লক্ষ্য করা। যেমন- থালায় হাত ঝাড়া, থুতু ফেলা, লোকমা নেওয়ার সময় থালার উপর ঝুঁকে পড়া।
২১. খাওয়ার সময় একেবারে চুপচাপ না থাকা। এটা অনারবদের অভ্যাস। বরং উত্তম কথাবার্তা এবং খাওয়ার ব্যাপারে সৎকর্মপরায়নদের গল্প ইত্যাদি বলতে থাকা।
২২. মেহমানদারীর খানায় মেহমানের পেট ভরে গেলে মেজবানের বরতনে কিছু খানা, তরকারি, রুটি রেখে দেওয়া উচিৎ, যাতে মেহমানের খানা কম পড়েছে মনে করে মেজবান লজ্জিত না হয়।
২৩. খাবার পর্ব শেষ হওয়ার পর বেশি কথাবার্তা বা আলাপচারিতায় লিপ্ত না হয়ে যত দ্রুত সম্ভব মেজবানের কাছ থেকে বিদায় নেয়া।
২৪. মেজবানের বাড়ি হতে মেহমানকে যদি কোথাও যেতে হয় তাহলে মেজবানকে জানিয়ে যাওয়া, যাতে আমাকে নিয়ে মেজবানের কোন দুশ্চিন্তা করতে না হয়। ২৫. মেজবানকে অবহিত না করে নফল রোজা না রাখা। ২৬. সৌজন্যতার সাথে কথাবার্তা বলা।
২৭. মেহমানের উচিত হলো তাঁর আওয়াজ ও কণ্ঠস্বর নিচু রাখা। অহেতুক চিল­াপাল­া না করা। ২৮. মেজবানকে অহেতুক প্রশ্ন করে বিব্রত না করা ।
২৯. যদি কোনো খারাপ কাজ বা কুসংস্কার পরিলক্ষিত হয়, সম্ভব হলে তা বিনয়ের সাথে সংশোধন করা। অন্যথায় মুখে বলে চলে আসা। বাড়াবাড়ি না করা। তবে যে দাওয়াতে গেলে গোনাহে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে, সেখানে দাওয়াত কবুল করা সুন্নাত নয়। ৩০.কারো বাড়িতে তিন দিনের বেশি অবস্থান করবে না।
৩১. মেজবানের অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করা। এত বেশিদিন অবস্থান না করা, যে কারণে মেজবানের কষ্ট হয় এবং মেহমানকে খাওয়ানোর মতো ভালো কিছু তার কাছে থাকে না।
৩২. মেহমানের সাথে যদি অনিমন্ত্রিত কেউ যুক্ত হয় তাহলে মেজবানের কাছে তার ব্যাপারে অনুমতি নেয়া। ৩৩. কারো বাড়িতে প্রতিদিন মেহমান হবে না। ৩৪. বাড়িওয়ালার নিকট কোনো কিছু চাইবে না। প্রয়োজন হলে কিবলা সম্পর্কে এবং ওয়াশরুম সম্পর্কে জানতে চাইবে।
৩৫. রাতযাপনের ইচ্ছা থাকলে প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড় ও জিনিসপত্র প্রভৃতি সাথে নেয়া। ৩৬. মেজবানকে দাওয়াত দেয়া। ৩৭. মেজবানের সম্মতি ও অনুমতি ব্যতীত বিদায় না নেওয়া।
৩৮. মেহমানদারিতে আদর আপ্যায়ন কম হয়ে থাকলে বা কোনো অসঙ্গতি বা ত্র“টি দেখা দিলে কোনো মন্তব্য না করা এবং মনোক্ষুন্ন না হওয়া; বরং হাসিমুখে আনন্দ চিত্তে বিদায় নেওয়া।
৩৯. মেজবানের জন্য দু’আ করা। এ প্রসঙ্গে রসূলাল­াহ্ সল­াল­াহু আলাইহি ওয়াসাল­াম থেকে বিভিন্ন দু’আ বর্ণিত হয়েছে।
যেমন: হে আল­াহ! আপনি তাদের রিযিকে বরকত দান করুন, তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং তাদের প্রতি রহম করুন। (সহীহ মুসলিম) আল­াহ তা’য়ালা আমাদেরকে মেজবানের হক আদায় করে আদর্শ মেহমান হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমিন।
আল­াহই সর্বজ্ঞ। 
সংকলক: লেখক ও গবেষক।