খুলনা | মঙ্গলবার | ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩ | ২১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩০

নিখোঁজ হিল্টনের মায়ের আকুতি ‘আমার ছেলের লাশ কোথায়?

এস এস শোহান ও মাহমুদ হাসান, বাগেরহাট |
০১:২৮ এ.এম | ২১ নভেম্বর ২০২৩


‘কবর দেওয়া লাশ যদি হিল্টনের না হয়, তাহলে আমার ছেলে লাশ কোথায়? আমার ছেলের লাশ আমারে দিয়ে যান। তারপরে লাশ উঠয়ে নিয়ে যান। আমার দাবি এটুকুই।’ সোমবার বেলা ১১টায় নিখোঁজ ব্যবসায়ী মাহে আলমের মরদেহ উঠনোর সময় এভাবেই বিলাপ করছিলেন নিখোঁজ হিল্টন নাথের মা বীথিকা নাথ। সাত মাস ১০ দিন আগে জেলে হিল্টন নাথ বলে খ্রিস্টান স¤প্রদায়ের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সমাহিত করা কবর থেকে ব্যবসায়ী মাহে আলমের মরদেহ উত্তোলনের সময় হিল্টন নাথের মা-বিথিকা নাথের কান্নায় হৃদয় বিদারক এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। মায়ের আজাহারিতে কাঁদলেন উপস্থিত অনেকেই।
পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী মোংলার চিলা গ্রামে হিল্টন নাথের সমাধি থেকে মোংলা উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) মোঃ হাবিবুর রহমান, সহকারী পুলিশ সুপার মুশফিকুর রহমান তুষার, মোংলা থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সামসুদ্দিনসহ স্থানীয়দের উপস্থিতিতে মাহে আলমের লাশটি উত্তোলন শুরু হয়। এসময় ঘরের কোনে বসে কাঁদছিলেন মা বীথিকা নাথ। সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘এত দিন ভাবিছি আমার তা (ছেলে) আমার কোলের ধারে রাইছে। এখন আমি কি করে থাকবো।...ওরে আমার বাবা রে। আপনারা আমার বাবারে এনে দেন’।
চলতি বছরের ৭ এপ্রিল সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়েছিল চিলা গ্রামের জেলে হিল্টন নাথ (২০)। এরপর থেকেই নিখোঁজ তিনি। ক’দিন বাদে ১৩ এপ্রিল সন্ধ্যার পর সুন্দরবনের করমজল এলাকায় পাওয়া যায় একটি অর্ধগলিত লাশ। স্থানীয়দের মাধ্যমে হিল্টন নাথের মা বীথিকা নাথ শোনেন তাঁর ছেলের লাশ মিলেছে। ছুটে যান ছেলের লাশের আসায়। তাঁর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ এপ্রিল খুলনার দাকোপ থানা-পুলিশ বীথিকা নাথের কাছে হস্তান্তর করে লাশটি। হিল্টন নাথের বাড়ি বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার চিলা গ্রামে। খ্রিস্টান ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী হিল্টন ভেবে সে লাশ বাড়িতে এনে সমাহিত করেন মা বীথিকা নাথ। তবে পরবর্তী ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদনে জানা যায় হিল্টন হিসেবে সমাহিত লাশটি আসলে মোংলা পৌর শহরের ব্যবসায়ী মাহে আলমের। তিনিও নিখোঁজ ছিলেন ১০ এপ্রিল থেকে। তাঁর ছেলের দাবির প্রেক্ষিতে লাশটি তাদের বুঝিয়ে দিতে আদেশ দেন আদালত। সেই অনুযায়ী সোমবার হিল্টন নাথের বাড়িতে ‘সমাহিত’ মাহে আলমের লাশ উত্তলন করা হয়। 
এদিকে হিল্টন নাথকে বন বিভাগের লোকজন মারছিল দাবি করে বীথিকা নাথ বলেন, “আমার ছেলে জাল ধরতি গেইলো। জাল ধরতি গেলি সেদিন ফরেস্টাররা মারিলো। মাররি গাঙ্গে (নদী) পড়িলো। আমার ছেলের সেই লাশ জোংড়ায় বলে ফরেস্টদের অফিসে বান্ধা ছিল। ফরেস্টাররা কি করিছে তা কতি পারিনা। পরে করমজলে খোঁজে এই লাশ পাইছি। আমাদের এলাকার বেল­াল, বেলায়েত জানতি পাইরে তারপরে করমজলের তে নিয়ে আইছে। আমার ছেলে হিসেবেই তো আমি দাফন দিছিলাম। যখন লাশ আনিছি, তহন তো কেউ বলেনি। লাশ নিয়ে সারা রাইত রইছি। কোর্টেতে বলে রায় দিছে, এই লাশ মাহে আলমের। তালি আমার ছেলে লাশ আইনে দেন।”
এদিকে গত ১০ এপ্রিল ভোরে বন বিভাগের জোংড়া ফরেস্ট ঘাটে একটি মরদেহ ভাসমান অবস্থায় দেখতে পায় স্থানীয়রা। কিন্ত কয়েক ঘন্টা পরে সে লাশের কোন হদিস মিলেনি। আবার ১৩ এপ্রিল রাত ১১টার দিকে করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র সংলগ্ন এলাকার সুন্দরবনের গহীন থেকে অর্ধগলিত একটি লাশ উদ্ধার করে দাকোপ থানা পুলিশ। ময়নাতদন্ত শেষে ১৪ এপ্রিল বিকেলে মরদেহটি হিল্টন নিখোঁজ নাথের বলে মা বিথিকা নাথ শনাক্ত করে খ্রিস্টীয় ধর্ম অনুযায়ী নিজ বাড়িতে সমাধি করে। তবে বন বিভাগের জোংড়া ফরেস্ট ঘাটে ভাসমান লাশ আর সুন্দরবন থেকে উদ্ধারকৃত লাশের মধ্যে বয়স ও পরিহিত পোষাকের ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে বলেও জানায় এলাকাবাসী। ১০ এপ্রিল ভোরে বন বিভাগের জোংড়া ফরেস্ট ঘাটে ভাসমান লাশটি কার এবং এটি অল্প সময়ের মধ্যে কোথায় হারিয়ে গেলো সে বিষয় অনুসন্ধান করলেই হিল্টন নাথ নিখোঁজের আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে বলে দাবী স্থানীয়দের। 
সহকারি কমিশনার (ভূমি) মোঃ হাবিবুর রহমান বলেন, ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে লাশটি আসলে হিলটনের নয়, মাহে আলমের। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা মরদেহ তুলে তার সন্তানদের কাছে হস্তান্তর করেছি। 
হিলটনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে যেহেতু ধারণা করা হয়েছিল এটি হিল্টন নাথের লাশ, সেহেতু তাঁর পরিবার একভাবে সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করেছিল। এখন যেহেতু এটা প্রমাণিত হয়েছে এটা মাহে আলমের লাশ সেহেতু হিল্টন জীবিত না মৃত এ বিষয়ে আমর কেউ নিশ্চিত নই। বিষয়টি নিয়ে খুলনা পিবিআই তদন্ত করছে। জীবিত বা মৃত হিল্টন যে অবস্থাতে আছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী খুঁজে বের করার জন্য চেষ্টা করছে।
মামলা সূত্রে জানা যায়, হিল্টন নাথ হত্যার বিষয়ে খুলনার দাকোপ থানায় এবং মাহে আলম নিখোঁজ বিষয়ে বাগেরহাটের মোংলা থানায় দু’টি পৃথক মামলা হয়। যা এখন তদন্তাধীন রয়েছে। 
হিল্টন নাথের মায়ের অভিযোগের বিষয়ে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের সহকারি বন সংরক্ষক মাহাবুব হাসান বলেন, ‘একজনকে মেরে বাকি তিনজনকে আদালতে তোলা সম্ভব? তাঁরা তো আদালতকে বলে দেবেন। কারও প্ররোচনায় তাঁরা মিথ্যা বলছেন।’ তিনি দাবি করেন, বনে জলদস্যু ও অন্যদের অবৈধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে তিনি অভিযান শুরু করেছিলেন। ফলে একটি পক্ষ ষড়যন্ত্র করে তাঁকে চাঁদপাই থেকে সরানোর চেষ্টা করে। তারাই এ ঘটনা সাজিয়েছে। তবে তারা কারা, সেই নাম তিনি জানাতে চাননি। এ ঘটনার পর সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জ অফিস থেকে তাঁকে শরণখোলা রেঞ্জে বদলি করা হয়।